ঢাকা ১১:৩১ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ৩ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
যুব মহিলালীগ নেত্রী লুনা হোসেন এবং তার স্বামীর বিরুদ্ধে জবরদখলের অভিযোগে মানববন্ধন ট্রাম্পের ‘শুল্ক বোমা’র আগে চীনের রপ্তানি ১২.৪% বৃদ্ধি ভারত থেকে ইউনুসকে সতর্ক বার্তা শেখ হাসিনার বেকার সাংবাদিক রাশেদুলের নিগ্রহের শিকার গৌতম আবারও ৮ লক্ষ টাকার ভারতীয় শাড়ী ও থ্রিপিচ জব্দ করেছে বংশাল থানা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা পেলেন বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী ১৮ রানে চেন্নাই কে হারালো পাঞ্জাব এসএ টিভিতে প্রচারিত প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছেন  থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। মাগুরার আছিয়া ধর্ষণ: ডিএনএ রিপোর্টে হিটু শেখের জড়িত থাকার প্রমাণ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করলেন কোরিয়ার বিনিয়োগ প্রতিনিধিদল
৭১ ও ২৪ এর দোষীদের দায় স্বীকার করার কি যৌক্তিক?

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪ এর অভ্যূত্থান এক ও অভিন্নঃ দাবী এনসিপি’র আহবায়ক নাহিদ ইসলামের

  • প্রদীপ বড়ুয়া জয়
  • আপডেট সময় : ০৩:৪৯:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ এপ্রিল ২০২৫
  • ১৬ বার পড়া হয়েছে

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত সহিংস ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সরকার-নিয়ন্ত্রিত বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক গোষ্ঠী যেভাবে নিরস্ত্র শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছে, তা বিশ্ব ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই ঘটনাকে ‘ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা  একে সরাসরি ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করছে।

পূর্বের বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় ঐক্য জোট সরকারের সময় শেষ হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মতানৈক্য শুরু হয়। একের পর এক বৈঠক করে কোন সুরাহা করতে পারেনি বিএনপি জামায়াত জোট তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে অন্যদিকে মহাজোটও তাদের সিদ্ধান্তে একই অবস্থানে থাকে। শেষদিকে লগিবৈঠা আন্দোলনের পর সেনাবাহিনী নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি ও জামায়াত নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোটের অবস্থা আর আওয়ামীলীগের ২০২৪ এর আগস্টের অবস্থা একই ছিল। দুই সময়ের মধ্যে পার্থক্য শুধু ২০০৭ এ মব জাস্টিসের নামে মব ভাইওলেন্স হয়নি।

পতিত আওয়ামীলীগ সরকারের কর্মকান্ড

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে। সেই মেয়াদে দলটি মহাজোটের সাথে ছিল আর তেমন স্বৈরাচারী বলে কেউ মনে করেনি। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব করে নির্বাচনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে আর ২০১৮ সালে বিরোধীদলকে বাইরে রেখে সংসদ নির্বাচন করে সরকার গঠন করার পর থেকেই আওয়ামীলীগকে কেউ আর অপছন্দ করতে শুরু করে। বলতে গেলে তখন থেকেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠে দলটি আর সরকারের সকল কর্মকান্ডকে বিতর্কিত করে তুলেছে সরকারে থাকা সকল এমপি ও মন্ত্রীসহ সরকারের আমলারা। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে আওয়ামীলীগের নেতাদের দৌরাত্ম ও নির্মমতা এতটাই বেঁড়ে যায় যে দেশের সর্বত্র দলীয় চাঁদাবাজি, অনিয়ম ও দূর্নীতি জনগনের মুখেমুখে হয়ে যায়। শেষ মেয়াদের সময় বলতে গেলে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে সাধারন মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

গণহত্যা বা জেনোসাইড এর সংজ্ঞা ও উৎপত্তি

‘জেনোসাইড’ শব্দটি প্রথমবারের মতো ১৯৪৪ সালে আইনজ্ঞ রাফায়েল লেমকিন দ্বারা উদ্ভাবিত হয়েছিল, যা নাৎসি জার্মানির ইহুদিদের প্রতি নির্যাতনের বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। লেমকিনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, গণহত্যা মানে কেবল নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা নয়; বরং তাদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্বকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সনদে এই সংজ্ঞা গৃহীত হয়, তবে সেখানে শুধুমাত্র জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল, রাজনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠীর ওপর নয়।

সমাজতত্ত্ববিদ ইরভিং লুই হরোউইটজের মতে, রাষ্ট্রযন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ব্যবহার করে যদি কোনো গোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়, তা স্পষ্টতই গণহত্যা। ডাচ আইনবিশারদ পিয়েতার এন ড্রস্ট বলেছেন, কোনো গোষ্ঠীর সদস্য হওয়াই যদি মৃত্যুর একমাত্র কারণ হয়, তবে সেটি অবশ্যই গণহত্যা।

এছাড়াও, ইতিহাসবিদ থমাস আর্ল পোর্টার দেখিয়েছেন, কোনো গোষ্ঠীর সামাজিক বন্ধন ভেঙে দেওয়ার সুপরিকল্পিত চেষ্টা গণহত্যার বড় লক্ষণ। গবেষক নেহেমিয়াহ রবিনসন স্পষ্ট করে বলেন, যদি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষকে বৈষম্যমূলকভাবে হত্যা করা হয়, সেটি গণহত্যা। মনোবিজ্ঞানী ইসরায়েল ডব্লিউ চার্নি বলেছেন, নিরুপায় নিরস্ত্র গোষ্ঠীর ওপর যখন সংঘবদ্ধভাবে গণহারে হত্যা চালানো হয়, সেটিকে নিঃসন্দেহে গণহত্যা বলা উচিত।

বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থান কি গণহত্যা ? 

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হত্যার মূল লক্ষ্য ছিল সরকারবিরোধী ছাত্রসমাজ ও তাদের সমর্থক গোষ্ঠী। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে স্পষ্ট নির্দেশে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী ও দলীয় ক্যাডাররা নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ করে, যা গণহত্যার মধ্যে পড়ে। আবার সরকার বিপক্ষীয় রাজনৈতিক দলগুলো পূর্ব ঘোষিত সরকার পতনের জন্য বিপ্লবের ঘোষণা দিত বা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হতো; আর যদি গণ অভ্যুত্থানে নিরস্ত্র জনতার উপর সরকারের হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটলে গণহত্যা হতো শতভাগ।

এই ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিয়েছে পাশাপাশা বিভিন্ন সংস্থার ভিন্নভিন্ন মতে গণহত্যার মধ্যে পড়ে কি পড়েনা সেই নিয়ে এখনও দ্বিধা বিভক্ত রয়েছে। ছাত্র জনতার কোটা বিরোধী আন্দোলন যখন স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় তখন পতিত সরকারের সকল  গৃহীত পদক্ষেপ অনৈতিক ও অগ্রহনযোগ্য সেটা বলা বাহুল্য। তবে স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ সরকার যদি ছাত্র-জনতাকে হটিয়ে টিকে যেত তাহলে আজ যারা বীরের ভেসে রাজত্ব করছে হয়তো তারা সবাই দেশদ্রোহী হতো সেটা রাজনৈতিকভাবেই কথিত ছিল ও আছে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহবায়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্য কি যৌক্তিক?

১৯৭১ আর ২০২৪ কে একই বলছেন এনসিপি আহবায়ক। এই নিয়ে এনসিপি ছাড়া প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের মাঝে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। যেমন আওয়ামীলীগ নতুন করে অস্বস্তিতে থাকলেও এদের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে রয়েছে জামায়াত-ই-ইসলাম। তবে সেই ক্ষেত্রে কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে রয়েছে বেশি কিছু প্রশ্ন ও দাবী। বিএনপি সমর্থিত বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্য অনুসারে, পূর্বে থেকেই ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা ভূখন্ড করে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করেছিল যার নাম বাংলাদেশ। আর সেই যুদ্ধে পূর্বে থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল জামায়াত-ই-ইসলামসহ অনেকগুলো দল। ৩০ লক্ষ হউক আর ৩০ হাজার হউক মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল তারা। কিন্তু অদ্যবদি তারা গণহত্যার দায় স্বীকার করেনি। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের দাবী যেন তারা দায় ও ভুল স্বীকার করুক। এছাড়াও ছাত্র-জনতার বিপ্লবে আওয়ামীলীগ সরকারের নির্বিচারে গুলি ও দমন পীড়নে আওয়ামীলীগকেও দায় স্বীকারের দাবী তাদের।

আবার সাধারন মানুষের মতে,  ২০২৪ এর জুলাই অভূত্থানকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকার করতে হলে আগে জামায়াতকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হত্যাগুলোকে গনহত্যার স্বীকৃতি পাইয়ে দিতে কোথাও আপত্তি থাকার কথা নয়। তাই নাহিদ ইসলামের এই দাবীকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে জামায়াত ই ইসলাম ও তাদের সমমনা সংগঠনগুলো। তবে উপরিউক্ত গণহত্যার সংজ্ঞা অনুযায়ী এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির আহবায়ক নাহিদ ইসলামের দাবী অনুযায়ী ১৯৭১ আর ২০২৪ এ একই কাতারে আনা উচিৎ এর উভয় দল ও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিৎ বলে অনেকেই মনে করেন।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই অভ্যুত্থান গণহত্যা কিনা?

তবে দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২৪ কে ৭১ এর সাথে তুলনা করা হচ্ছে রাজনৈতিক ছেলে খেলা ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের মতে আমরা পূর্বে সামরিক শাসক ও স্বৈরাশাসকের বিরুদ্ধে প্রায় যুগ ধরে লড়াই করেছে মানুষ এরপর ৯০ এর গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার পতন হয়েছে, ২০০৬ সালেও লগি বৈঠা আন্দোলন হয়েছে। এসব কিছুই ক্ষমতাসীন সরকারকে পতন করে অন্য রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনৈতিক কার্যক্রম ছাড়া কিছুই ছিলনা। সেই ক্ষেত্রে ২৪ এর গণ অভ্যুত্থানকে ৭১ এর সাথে তুলনা করা হবে মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদের সাথে গাদ্দারি করা। তাই এই অংশের মতে, ২৪ এর অভ্যূত্থান একা কারও অংশগ্রহনের ফসল নয় বরং দীর্ঘদিন বিরোধীদলগুলোর প্রতি দমন পীড়ন ও গুম-খুনের প্রতি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ফসল। এই অভ্যুত্থানে বিএনপির সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল, তবে মাস্টার মাইন্ড হিসেবে তাদের অংশগ্রহন ছিল সেটা দলের পক্ষ থেকে একবারও বলা হয়নি। তবে সুযোগ বুঝে সকল দলীয় নেতাকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আর তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেই সরকার পতনে বাধ্য হয়েছিল বলেই বিএনপির পক্ষ থেকেই জোরালো দাবী করা হয়েছে। তবে ২৪ এর চেতনায় বিএনপি ধারন করে এবং ছাত্র -জনতার নেতৃত্ব মেনেই যোগ দিয়েছে সেটা অনেক নেতাই ইতোমধ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন।

উপরোক্ত গবেষকদের সংজ্ঞা ও বিশ্লেষণের আলোকে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত সহিংস ঘটনাগুলোকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। রাষ্ট্র পরিচালিত নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগ, নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর পরিকল্পিত হামলা, গুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সবই গণহত্যার বৈশিষ্ট্য বহন করে। গ্রেগরি স্ট্যান্টনের ‘Eight Stages of Genocide’ মডেল অনুযায়ী, এই আটটি ধাপ—বিভাজন, প্রতীকায়ন, অমানবিকীকরণ, সংগঠন, মেরুকরণ, প্রস্তুতি, নির্মূলকরণ এবং অস্বীকার—২০২৪ সালের বাংলাদেশে স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই শুধু মাত্র ২৪ এর জুলাই নয় ৭১কেও এরই আওতায় আনা হলে জাতির বেশিরভাবে নিরপেক্ষ জনগণ আজীবন এই পদক্ষেপকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখবে।

ট্যাগস :

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

জনপ্রিয় সংবাদ

যুব মহিলালীগ নেত্রী লুনা হোসেন এবং তার স্বামীর বিরুদ্ধে জবরদখলের অভিযোগে মানববন্ধন

৭১ ও ২৪ এর দোষীদের দায় স্বীকার করার কি যৌক্তিক?

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪ এর অভ্যূত্থান এক ও অভিন্নঃ দাবী এনসিপি’র আহবায়ক নাহিদ ইসলামের

আপডেট সময় : ০৩:৪৯:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ এপ্রিল ২০২৫

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত সহিংস ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সরকার-নিয়ন্ত্রিত বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক গোষ্ঠী যেভাবে নিরস্ত্র শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছে, তা বিশ্ব ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই ঘটনাকে ‘ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা  একে সরাসরি ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করছে।

পূর্বের বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় ঐক্য জোট সরকারের সময় শেষ হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মতানৈক্য শুরু হয়। একের পর এক বৈঠক করে কোন সুরাহা করতে পারেনি বিএনপি জামায়াত জোট তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে অন্যদিকে মহাজোটও তাদের সিদ্ধান্তে একই অবস্থানে থাকে। শেষদিকে লগিবৈঠা আন্দোলনের পর সেনাবাহিনী নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি ও জামায়াত নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোটের অবস্থা আর আওয়ামীলীগের ২০২৪ এর আগস্টের অবস্থা একই ছিল। দুই সময়ের মধ্যে পার্থক্য শুধু ২০০৭ এ মব জাস্টিসের নামে মব ভাইওলেন্স হয়নি।

পতিত আওয়ামীলীগ সরকারের কর্মকান্ড

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে। সেই মেয়াদে দলটি মহাজোটের সাথে ছিল আর তেমন স্বৈরাচারী বলে কেউ মনে করেনি। কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব করে নির্বাচনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে আর ২০১৮ সালে বিরোধীদলকে বাইরে রেখে সংসদ নির্বাচন করে সরকার গঠন করার পর থেকেই আওয়ামীলীগকে কেউ আর অপছন্দ করতে শুরু করে। বলতে গেলে তখন থেকেই স্বৈরাচারী হয়ে উঠে দলটি আর সরকারের সকল কর্মকান্ডকে বিতর্কিত করে তুলেছে সরকারে থাকা সকল এমপি ও মন্ত্রীসহ সরকারের আমলারা। এছাড়াও স্থানীয়ভাবে আওয়ামীলীগের নেতাদের দৌরাত্ম ও নির্মমতা এতটাই বেঁড়ে যায় যে দেশের সর্বত্র দলীয় চাঁদাবাজি, অনিয়ম ও দূর্নীতি জনগনের মুখেমুখে হয়ে যায়। শেষ মেয়াদের সময় বলতে গেলে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে সাধারন মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল।

গণহত্যা বা জেনোসাইড এর সংজ্ঞা ও উৎপত্তি

‘জেনোসাইড’ শব্দটি প্রথমবারের মতো ১৯৪৪ সালে আইনজ্ঞ রাফায়েল লেমকিন দ্বারা উদ্ভাবিত হয়েছিল, যা নাৎসি জার্মানির ইহুদিদের প্রতি নির্যাতনের বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। লেমকিনের সংজ্ঞা অনুযায়ী, গণহত্যা মানে কেবল নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সদস্যদের হত্যা করা নয়; বরং তাদের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্বকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত কর্মকাণ্ড।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সনদে এই সংজ্ঞা গৃহীত হয়, তবে সেখানে শুধুমাত্র জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল, রাজনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠীর ওপর নয়।

সমাজতত্ত্ববিদ ইরভিং লুই হরোউইটজের মতে, রাষ্ট্রযন্ত্রের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো ব্যবহার করে যদি কোনো গোষ্ঠীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়, তা স্পষ্টতই গণহত্যা। ডাচ আইনবিশারদ পিয়েতার এন ড্রস্ট বলেছেন, কোনো গোষ্ঠীর সদস্য হওয়াই যদি মৃত্যুর একমাত্র কারণ হয়, তবে সেটি অবশ্যই গণহত্যা।

এছাড়াও, ইতিহাসবিদ থমাস আর্ল পোর্টার দেখিয়েছেন, কোনো গোষ্ঠীর সামাজিক বন্ধন ভেঙে দেওয়ার সুপরিকল্পিত চেষ্টা গণহত্যার বড় লক্ষণ। গবেষক নেহেমিয়াহ রবিনসন স্পষ্ট করে বলেন, যদি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষকে বৈষম্যমূলকভাবে হত্যা করা হয়, সেটি গণহত্যা। মনোবিজ্ঞানী ইসরায়েল ডব্লিউ চার্নি বলেছেন, নিরুপায় নিরস্ত্র গোষ্ঠীর ওপর যখন সংঘবদ্ধভাবে গণহারে হত্যা চালানো হয়, সেটিকে নিঃসন্দেহে গণহত্যা বলা উচিত।

বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থান কি গণহত্যা ? 

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হত্যার মূল লক্ষ্য ছিল সরকারবিরোধী ছাত্রসমাজ ও তাদের সমর্থক গোষ্ঠী। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে স্পষ্ট নির্দেশে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী ও দলীয় ক্যাডাররা নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর ওপর আক্রমণ করে, যা গণহত্যার মধ্যে পড়ে। আবার সরকার বিপক্ষীয় রাজনৈতিক দলগুলো পূর্ব ঘোষিত সরকার পতনের জন্য বিপ্লবের ঘোষণা দিত বা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হতো; আর যদি গণ অভ্যুত্থানে নিরস্ত্র জনতার উপর সরকারের হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটলে গণহত্যা হতো শতভাগ।

এই ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিয়েছে পাশাপাশা বিভিন্ন সংস্থার ভিন্নভিন্ন মতে গণহত্যার মধ্যে পড়ে কি পড়েনা সেই নিয়ে এখনও দ্বিধা বিভক্ত রয়েছে। ছাত্র জনতার কোটা বিরোধী আন্দোলন যখন স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের আন্দোলনে রূপ নেয় তখন পতিত সরকারের সকল  গৃহীত পদক্ষেপ অনৈতিক ও অগ্রহনযোগ্য সেটা বলা বাহুল্য। তবে স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ সরকার যদি ছাত্র-জনতাকে হটিয়ে টিকে যেত তাহলে আজ যারা বীরের ভেসে রাজত্ব করছে হয়তো তারা সবাই দেশদ্রোহী হতো সেটা রাজনৈতিকভাবেই কথিত ছিল ও আছে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহবায়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্য কি যৌক্তিক?

১৯৭১ আর ২০২৪ কে একই বলছেন এনসিপি আহবায়ক। এই নিয়ে এনসিপি ছাড়া প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের মাঝে চলছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। যেমন আওয়ামীলীগ নতুন করে অস্বস্তিতে থাকলেও এদের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে রয়েছে জামায়াত-ই-ইসলাম। তবে সেই ক্ষেত্রে কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে রয়েছে বেশি কিছু প্রশ্ন ও দাবী। বিএনপি সমর্থিত বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের বক্তব্য অনুসারে, পূর্বে থেকেই ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা ভূখন্ড করে আলাদা রাষ্ট্র গঠন করেছিল যার নাম বাংলাদেশ। আর সেই যুদ্ধে পূর্বে থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল জামায়াত-ই-ইসলামসহ অনেকগুলো দল। ৩০ লক্ষ হউক আর ৩০ হাজার হউক মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল তারা। কিন্তু অদ্যবদি তারা গণহত্যার দায় স্বীকার করেনি। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের দাবী যেন তারা দায় ও ভুল স্বীকার করুক। এছাড়াও ছাত্র-জনতার বিপ্লবে আওয়ামীলীগ সরকারের নির্বিচারে গুলি ও দমন পীড়নে আওয়ামীলীগকেও দায় স্বীকারের দাবী তাদের।

আবার সাধারন মানুষের মতে,  ২০২৪ এর জুলাই অভূত্থানকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকার করতে হলে আগে জামায়াতকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে হত্যাগুলোকে গনহত্যার স্বীকৃতি পাইয়ে দিতে কোথাও আপত্তি থাকার কথা নয়। তাই নাহিদ ইসলামের এই দাবীকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে জামায়াত ই ইসলাম ও তাদের সমমনা সংগঠনগুলো। তবে উপরিউক্ত গণহত্যার সংজ্ঞা অনুযায়ী এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির আহবায়ক নাহিদ ইসলামের দাবী অনুযায়ী ১৯৭১ আর ২০২৪ এ একই কাতারে আনা উচিৎ এর উভয় দল ও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করা উচিৎ বলে অনেকেই মনে করেন।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই অভ্যুত্থান গণহত্যা কিনা?

তবে দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২৪ কে ৭১ এর সাথে তুলনা করা হচ্ছে রাজনৈতিক ছেলে খেলা ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের মতে আমরা পূর্বে সামরিক শাসক ও স্বৈরাশাসকের বিরুদ্ধে প্রায় যুগ ধরে লড়াই করেছে মানুষ এরপর ৯০ এর গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার পতন হয়েছে, ২০০৬ সালেও লগি বৈঠা আন্দোলন হয়েছে। এসব কিছুই ক্ষমতাসীন সরকারকে পতন করে অন্য রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনৈতিক কার্যক্রম ছাড়া কিছুই ছিলনা। সেই ক্ষেত্রে ২৪ এর গণ অভ্যুত্থানকে ৭১ এর সাথে তুলনা করা হবে মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদের সাথে গাদ্দারি করা। তাই এই অংশের মতে, ২৪ এর অভ্যূত্থান একা কারও অংশগ্রহনের ফসল নয় বরং দীর্ঘদিন বিরোধীদলগুলোর প্রতি দমন পীড়ন ও গুম-খুনের প্রতি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ফসল। এই অভ্যুত্থানে বিএনপির সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল, তবে মাস্টার মাইন্ড হিসেবে তাদের অংশগ্রহন ছিল সেটা দলের পক্ষ থেকে একবারও বলা হয়নি। তবে সুযোগ বুঝে সকল দলীয় নেতাকর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আর তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেই সরকার পতনে বাধ্য হয়েছিল বলেই বিএনপির পক্ষ থেকেই জোরালো দাবী করা হয়েছে। তবে ২৪ এর চেতনায় বিএনপি ধারন করে এবং ছাত্র -জনতার নেতৃত্ব মেনেই যোগ দিয়েছে সেটা অনেক নেতাই ইতোমধ্যে স্বীকার করে নিয়েছেন।

উপরোক্ত গবেষকদের সংজ্ঞা ও বিশ্লেষণের আলোকে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত সহিংস ঘটনাগুলোকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। রাষ্ট্র পরিচালিত নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগ, নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর পরিকল্পিত হামলা, গুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সবই গণহত্যার বৈশিষ্ট্য বহন করে। গ্রেগরি স্ট্যান্টনের ‘Eight Stages of Genocide’ মডেল অনুযায়ী, এই আটটি ধাপ—বিভাজন, প্রতীকায়ন, অমানবিকীকরণ, সংগঠন, মেরুকরণ, প্রস্তুতি, নির্মূলকরণ এবং অস্বীকার—২০২৪ সালের বাংলাদেশে স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। তাই শুধু মাত্র ২৪ এর জুলাই নয় ৭১কেও এরই আওতায় আনা হলে জাতির বেশিরভাবে নিরপেক্ষ জনগণ আজীবন এই পদক্ষেপকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখবে।