স্তন ক্যান্সারের বৈশ্বিক ও ভারতীয় পরিসংখ্যান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি ২০ জন নারীর মধ্যে অন্তত একজন তার জীবদ্দশায় স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর নতুন স্তন ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা ৩২ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভারতের ক্যান্সার গবেষণা কাউন্সিল (ICMR) জানাচ্ছে, ভারতীয় নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০১৯ সালে যেখানে ২ লাখের বেশি কেস নথিভুক্ত হয়েছিল, ২০২৩ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.২ লাখে। গবেষণা বলছে, প্রতি বছর এই সংখ্যা ১০% হারে বাড়ছে।
‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত ‘Economic Burden of Breast Cancer in India-2020-2021 and Forecast to 2030’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসাধীন নারীদের সংখ্যা প্রতি বছর ৫০,০০০ করে বাড়বে। এর ফলে চিকিৎসা ব্যয়ও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
স্তন ক্যান্সার এবং বয়সগত প্রবণতা
স্তন ক্যান্সার সাধারণত ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে বর্তমানে কমবয়সীদের মধ্যেও এই রোগের হার বেড়ে গেছে। অ্যাপোলো হাসপাতালের গবেষণা অনুযায়ী, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ২৫% রোগীর বয়স ৩৯ বা তার কম। কিছু ক্ষেত্রে মাত্র ২৩-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যেও স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে।
দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালের সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট রুকেয়া আহমেদ মীর জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের হার বেড়েছে। তার মতে, ভারতের সর্বকনিষ্ঠ স্তন ক্যান্সার রোগীর বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর।
কলকাতার অনকোলজিস্ট গৌতম মুখার্জি বলেন, “ভারতে স্তন ক্যান্সার এখন নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে, যা আগে জরায়ু ক্যান্সারের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা হতো।”
স্তন ক্যান্সারের কারণসমূহ
বিশেষজ্ঞরা স্তন ক্যান্সারের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন:
১. জেনেটিক ফ্যাক্টর: পরিবারের মধ্যে কারও স্তন ক্যান্সার থাকলে ঝুঁকি বাড়ে। BRCA1 এবং BRCA2 জিনের পরিবর্তন স্তন ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। ২. জীবনধারা: জাঙ্ক ফুড গ্রহণ, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, ওবেসিটি, অ্যালকোহল গ্রহণ স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ৩. হরমোনজনিত কারণ: লেট মেনোপজ (৫৫ বছরের পরে), প্রথম গর্ভধারণ দেরিতে হওয়া (৩০ বছরের পরে), বেশি সময় ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণ ওষুধ গ্রহণ করাও ঝুঁকি বাড়ায়। ৪. পরিবেশগত কারণ: বায়ুদূষণ, কীটনাশকের সংস্পর্শ, রেডিয়েশন এক্সপোজার স্তন ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। ৫. ধূমপান ও মদ্যপান: দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান বা মদ্যপানের অভ্যাস স্তন ক্যান্সারের অন্যতম কারণ।
স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়
ক্যান্সার প্রতিরোধে সচেতনতা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা পরামর্শ দিয়েছেন:
১. নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা ব্যায়াম করা দরকার। ২. সুষম খাদ্যাভ্যাস: ফাস্ট ফুড এড়িয়ে প্রচুর শাক-সবজি ও প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত। ৩. ওজন নিয়ন্ত্রণ: অতিরিক্ত ওজন স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়ায়। ৪. ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার: এটি স্তন ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। ৫. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা: ৪০ বছরের পরে নিয়মিত ম্যামোগ্রাফি করানো উচিত। ২০ বছরের পর থেকেই নিয়মিত সেলফ এগজামিনেশন করা উচিত।
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ
১. স্তনের আকার পরিবর্তন ২. স্তনে চাকা বা লাম্প অনুভব করা ৩. স্তনের চামড়ায় রঙ পরিবর্তন বা দাগ পড়া ৪. স্তনের নিপল থেকে অস্বাভাবিক রক্ত বা তরল নির্গমন ৫. বগলের নিচে ব্যথাহীন চাকা বা গিঁট ৬. স্তনে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভব করা
স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা
বিশেষজ্ঞদের মতে, স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হলে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা জরুরি। চিকিৎসার প্রধান পদ্ধতিগুলো হলো:
১. সার্জারি: আক্রান্ত টিস্যু বা সম্পূর্ণ স্তন অপসারণ করা হয়। ২. কেমোথেরাপি: ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। ৩. রেডিওথেরাপি: রেডিয়েশন দিয়ে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়। ৪. হরমোন থেরাপি: কিছু নির্দিষ্ট স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর। ৫. টার্গেটেড থেরাপি: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওষুধ প্রয়োগ করা হয়।
স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি
অনেক নারী স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতন নন এবং দেরিতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। এজন্য:
- সচেতনতা ক্যাম্প: বিভিন্ন হাসপাতাল ও সংস্থার উদ্যোগে সচেতনতা শিবির করা উচিত।
- সেলফ এগজামিনেশন শেখানো: নারীদের নিয়মিত স্তন পরীক্ষা করার প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।
- সঠিক তথ্য প্রদান: ভুল ধারণা দূর করতে গণমাধ্যমের সহযোগিতা প্রয়োজন।
উপসংহার
স্তন ক্যান্সার একটি গুরুতর রোগ, তবে দ্রুত শনাক্ত ও সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। সচেতনতা ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার মাধ্যমে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানো যায়। নারীদের উচিত নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।
বিশ্বজুড়ে স্তন ক্যান্সার গবেষণা ও চিকিৎসা উন্নত হচ্ছে, তাই সঠিক সময়ে পদক্ষেপ নিলে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।