গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সম্প্রতি একটি সুপারিশমালা প্রস্তুত করেছে, যেখানে সাংবাদিকতার পেশার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হয়েছে। এই সুপারিশমালা প্রস্তুতের জন্য কমিশন ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে বৈঠক করেছে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালার শুরুতেই বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণমাধ্যমের মালিকানার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং একক মালিকানা ও একাধিক গণমাধ্যমের মালিকানা অর্জনের বিষয়গুলোতেও সংস্কার শুরু হয়েছে সারা বিশ্বে। সেই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশেও গণমাধ্যমের মালিকানা বিষয়ে সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশের গণমাধ্যমে কালো টাকা ঢুকেছে। মালিকানা সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বিগত সময়ে উন্মুক্তভাবে গণমাধ্যমের লাইসেন্স না দিয়ে দেয়া হয়েছে নেপথ্যে, যোগসাজশে, রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায়।” তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক ব্যক্তির মালিকানায় টেলিভিশন ও পত্রিকা থাকার নিয়ম নেই।
কমিশন প্রস্তাব করেছে যে, গণমাধ্যম মালিকানা বিষয়ে ‘ওয়ান হাউজ, ওয়ান মিডিয়া’ নীতির অনুসরণ করা উচিত। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কেবলমাত্র একটি গণমাধ্যমের মালিক হতে পারবেন। বর্তমানে বাংলাদেশে বেশ কিছু শিল্পগোষ্ঠী একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল, পত্রিকা এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যমের মালিকানায় রয়েছে।
নতুন সুপারিশ কার্যকর হলে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের হয় তাদের মালিকানাধীন গণমাধ্যমের মধ্যে একটিকে রেখে অন্যগুলো বিক্রি করতে হবে, অথবা দুটি প্রতিষ্ঠান একত্রিত করে হয় টেলিভিশন বা পত্রিকা চালাতে হবে।
কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, বৃহৎ ও মধ্যম আকারের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ‘পাবলিক লিস্টেড কোম্পানি’ মডেলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে, যেখানে সাংবাদিক ও কর্মচারীদের মালিকানায় অংশীদার বানানোর সুযোগ থাকবে।
সাংবাদিকদের যোগ্যতা ও বেতন কাঠামো
সাংবাদিকদের যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে কমিশন প্রস্তাব করেছে যে, জাতীয় পর্যায়ে কিংবা সারা দেশে রিপোর্টার বা প্রতিনিধি নিয়োগের জন্য ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার বিধিবিধান নেই, যা পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে কমিশন।
কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ জানান, শুধুমাত্র সাংবাদিকদের জন্য নয়, সম্পাদক ও প্রকাশকের যোগ্যতা সম্পর্কেও সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া, সাংবাদিকদের জন্য এক বছরের শিক্ষানবিশকাল বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যার পরে তারা পূর্ণাঙ্গ সাংবাদিকের মর্যাদা পাবেন।
সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে কমিশন সুপারিশ করেছে যে, সাংবাদিকদের প্রবেশপদের ন্যূনতম বেতন বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের নবম গ্রেডের সমপরিমাণ হওয়া উচিত। বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য কার্যকর ২০১৫ সালের বেতন কাঠামো অনুযায়ী, নবম গ্রেডে চাকরি শুরুর সময় একজন কর্মকর্তার মূল বেতন ২২,০০০ টাকা। এর সঙ্গে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও যাতায়াত ভাতাসহ বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা যুক্ত হয়।
ঢাকার জীবনযাত্রার ব্যয় তুলনামূলক বেশি হওয়ায়, ঢাকার সাংবাদিকদের জন্য অতিরিক্ত ‘ঢাকা ভাতা’ নির্ধারণেরও সুপারিশ করা হয়েছে। এই ভাতার পরিমাণ নির্ধারণের জন্য সরকার ও সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেবে।
এছাড়া, কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করানো যাবে না এবং তাদের সংবাদ সংগ্রহের বাইরের কার্যক্রম, যেমন সার্কুলেশন তদারকি ও বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কাজে নিয়োগ করা যাবে না বলে কমিশন সুপারিশ করেছে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে সাংবাদিকদের পেশাগত মানোন্নয়ন, আর্থিক নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশের উন্নতি এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।