রমজান মাসে বিশ্বজুড়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রোজা পালন করেন। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম হলো এই রোজা। ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে মুসলমানরা আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধি অনুশীলন করেন। আল্লাহতায়াল সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন, হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য রোজার বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগণকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে করে তোমরা তাকওয়া বা আল্লাহ ভীরুতা অবলম্বন করতে পারো।
এছাড়াও এই মাসের স্বামী স্ত্রীর প্রতি অনুগত্য ও ভালবাসা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে এই মাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে অতি নিবিড় ও গভীরতার পাশাপাশি একে অপরের পরিপূরক হিসেবেও বলা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা সুরা বাকারার ১৮৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন, রমজানের রাতে তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের বৈধ করা হয়েছে। তারা তোমাদের জন্যে এবং তোমরাও তাদের জন্যে পরিচ্ছদ। আল্লাহ জানেন, তোমরা তোমাদের নিজেদের সঙ্গে খিয়ানত করেছিলে, অতঃপর তিনি তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদের মাফ করেছেন।
রমজানকে সিয়াম সাধনার মাস হিসেবেও অনেকে আখ্যা দিয়ে থাকেন। মানুষকে সৎ পথে পরিচালিত করতে এবং আল্লাহর প্রতি ইবাদত করতে ও আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে রমজান মাসের গুরুত্ব অনেক। কোরআনুল কারিমে সুরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, রমজান মাস। এ মাস পেলেই মুমিন মুসলমানের জন্য রোজা রাখা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে তারা যেন এ মাসে সিয়াম পালন করে এবং কেউ অসুস্থ থাকলে কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা সহজ তাই চান এবং যা তোমাদের জন্যে কষ্টকর তা চান না। এ জন্য যে তোমাদের সংখ্যা পূর্ণ করবে এবং তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার কারণে তোমরা আল্লাহর মাহিমা ঘোষণা করবে এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।
রমজান মাসে গরিব ও ফকির মিসকিনকে দান করার জন্য আল্লাহ উৎসাহিত করেছেন। মানুষ স্বেচ্ছায় আল্লাহর সন্তুস্টির জন্য সৎ কর্ম করে আল্লাহর খুব নিকটে আসতে পারে। সুরা বাকারার ১৮৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, আর যারা রোজা রাখার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও রোজা রাখতে চায় না (যারা রোজা রাখতে অক্ষম), তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। পরন্তু যে ব্যক্তি খুশির সঙ্গে সৎকর্ম করে, তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি তোমরা রোজা রাখ, তাহলে তা তোমাদের জন্য বিশেষ কল্যাণের; যদি তোমরা উপলব্ধি করতে পারো।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, রমজানে তোমরা তাদের সঙ্গে সংগত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা নির্ধারণ করে রেখেছেন তা অন্বেষণ করো। আর তোমরা আহার করো ও পান করো যতক্ষণ তোমাদের জন্য (রাত্রির) কালো রেখা থেকে ফজরের সাদা রেখা স্পষ্ট হয়ে যায়। এরপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ করো। আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফ অবস্থায় তাদের সঙ্গে সংগত হয়ো না। এগুলো আল্লাহর (নির্ধারিত) সীমা, সুতরাং এর নিকটবর্তী হয়ো না।
রোজার রয়েছে অসংখ্য আধ্যাত্মিক ও স্বাস্থ্যগত উপকারিতা। তবে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার কারণে কেউ কেউ ক্লান্তি, অবসাদ বা পানিশূন্যতার সম্মুখীন হতে পারেন। বিশেষত উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদী অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এই পরিবর্তন সামলানো কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। তাই পুষ্টিবিদদের পরামর্শ অনুসরণ করে সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুললে রমজান স্বাস্থ্যকর ও প্রাণবন্তভাবে কাটানো সম্ভব।
সেহরি: দিনের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ খাবার
রমজানে সেহরি হলো দিনের শক্তির মূল উৎস। পুষ্টিবিদ ফাদি আব্বাস পরামর্শ দিয়েছেন, সেহরিতে এমন খাবার গ্রহণ করা উচিত যাতে উচ্চমাত্রায় পানি ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থাকে। তিনি সেহরিকে তিনটি ধাপে ভাগ করেছেন:
প্রথম ধাপ:
- সালাদ দিয়ে সেহরি শুরু করা ভালো, যাতে শসা, লেটুস, গাজর ইত্যাদি থাকে।
- কম লবণযুক্ত খাবার গ্রহণ করা উচিত, কারণ অতিরিক্ত লবণ পানিশূন্যতা বাড়িয়ে দেয়।
দ্বিতীয় ধাপ:
- শর্করা ও প্রাকৃতিক চিনি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করা উচিত, যেমন তরমুজ, কমলা ইত্যাদি।
- চাইলে এসব ফলের জুস করেও খাওয়া যেতে পারে।
তৃতীয় ধাপ:
- পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা জরুরি।
- চা ও কফি এড়িয়ে চলা ভালো, কারণ এগুলো মূত্রবর্ধক এবং শরীর থেকে দ্রুত পানি বের করে দেয়।
ইফতার: সুষম খাবারের প্রয়োজনীয়তা
ইফতার রোজাদারদের জন্য দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার পর শরীরের শক্তি পুনরুদ্ধারের সুযোগ দেয়।
ইফতারের ধাপসমূহ:
- প্রথমে এক গ্লাস পানি এবং খেজুর বা প্রাকৃতিক ফলের রস পান করা উচিত।
- ছয় মিনিট পর হালকা সালাদ গ্রহণ করা ভালো, যা ফাইবার সমৃদ্ধ ও সহজপাচ্য।
- তারপর প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া যেতে পারে, যেমন খিচুড়ি, রুটি বা ভাত।
- অতিরিক্ত তেল ও চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা দরকার, যা হজমে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
সংযম ও স্বাস্থ্য রক্ষার গুরুত্ব
রমজান শুধু খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাস নয়, এটি সংযমের মাস। এ সময় খাবারের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি পরিহার করা প্রয়োজন। অতিরিক্ত ভোজন অলসতা, গ্যাস্ট্রিক ও ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। তাই সঠিক পরিমাণে এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
রমজানের আধ্যাত্মিক ও শারীরিক উপকারিতা
রমজান আত্মশুদ্ধি ও সংযম অনুশীলনের মাস। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “রমজান হলো এমন একটি মাস, যার প্রথম অংশ রহমত, মধ্য অংশ মাগফিরাত এবং শেষ অংশ নাজাত।”
স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও রোজার অনেক উপকারিতা রয়েছে:
- ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
- বিপাকক্রিয়া উন্নত করে এবং হজম শক্তি বাড়ায়।
- শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান দূর করে।
- মানসিক প্রশান্তি ও আত্মসংযম শেখায়।
উপসংহার
রমজানে সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করলে শরীর ও মনের সুস্থতা বজায় রাখা সম্ভব। সেহরি ও ইফতারে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, পর্যাপ্ত পানি পান, সংযম চর্চা এবং নিয়মিত ইবাদতের মাধ্যমে রমজানের প্রকৃত শিক্ষা ও উপকারিতা লাভ করা সম্ভব।