সোমবার সকাল সাড়ে ৬টায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দু, মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হলেন বাংলাদেশের পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল। প্রতিকূল আবহাওয়া এবং শ্বাসরুদ্ধকর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ৮,৮৪৮.৮৬ মিটার উচ্চতায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন তিনি। এটি কেবল একটি ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং ‘সি টু সামিট’ নামক এক মহৎ পরিবেশ সচেতনতামূলক অভিযানের চূড়ান্ত সাফল্য।
শাকিলের ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায়, এভারেস্টের চূড়ায় তার যাত্রা মোটেই সহজ ছিল না। মাথার ওপর বিশুদ্ধ নীল আকাশের বদলে প্রকৃতি চেয়েছিল চরম পরীক্ষা। হিমালয়ের গভীরে বরফের মধ্য দিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল জীবন-মৃত্যুর এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য। যমুনা নদীর খরস্রোতা ঢেউ থেকে শুরু করে খুম্বু আইসফল, লোৎসে ফেস, সাউথ কল এবং হিলারি স্টেপের মতো প্রতিটি ধাপই ছিল একেকটি মানসিক যুদ্ধক্ষেত্র। অক্সিজেনের অভাবে মাস্কবদ্ধ মুখে যখন মনে হচ্ছিল আর পেরে ওঠা যাবে না, তখন হৃদয়ে বাজতে থাকা বাংলাদেশের নাম এবং ‘সি টু সামিট’ অভিযানের অঙ্গীকারই তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
শাকিলের এই এভারেস্ট অভিযান ছিল ‘সি টু সামিট’ নামের একটি বৃহৎ মিশনের অংশ। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পর্বতশিখর পর্যন্ত একটি জোরালো বার্তা পৌঁছে দেওয়া— পৃথিবী আমাদের, আমাদেরই দায়িত্ব প্লাস্টিক দূষণ ও কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে টিকিয়ে রাখা আমাদের ভবিষ্যৎ।
তার এই যাত্রা শুরু হয়েছিল বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্র সৈকত থেকে, যেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যে সাগর, সমতল ও পাহাড়ের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। সেই দূষণ ও পরিবর্তনের বার্তা নিয়েই তিনি পর্বতমুখী হয়েছিলেন, যেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শিখরে দাঁড়িয়ে বলতে পারেন, আমরা যদি পাহাড় জয় করতে পারি, তবে নিজের ভেতরের অসচেতনতাকেও জয় করতে পারি।
শাকিলের কাছে পর্বতারোহণ নিছকই একটি অ্যাডভেঞ্চার নয়, এটি একটি দায়িত্ব, একটি প্রতিবাদ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি এক প্রতিজ্ঞা। তিনি সমুদ্র থেকে শুরু করে বরফাবৃত শিখরে উঠে জোর দিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সময় এখনই। তিনি সতর্ক করেছেন, যদি আমরা আজ সচেতন না হই, কাল হয়তো কোনো এভারেস্টই থাকবে না, থাকবে না আমাদের হাঁটার মতো পথ, বাঁচার মতো বাতাস।
এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে শাকিল কৃতজ্ঞতায়, আনন্দে এবং দায়িত্ববোধে কেঁদেছেন। তিনি মনে করেন, এই আরোহণ কেবল তার একার নয়, এটি তার দেশ, তার মানুষ এবং সেই সকল তরুণের, যারা আজও স্বপ্ন দেখে নিজের সীমা ভেঙে কিছু করে দেখানোর।
শাকিল তার এই অসাধ্য সাধনের জন্য গাইড ও বন্ধু তাশি গ্যালজেন শেরপাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তাদের দুজনের প্রায় দুই বছরের পরিকল্পনা সফল হয়েছে। শাকিল তার ‘সি টু সামিট’ অভিযান সফলভাবে শেষ করেছেন এবং গ্যালজেন ২০ দিনে চারবার এভারেস্ট সামিট করার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়াও, শাকিল তার অভিযানের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করা সকল মানুষ, যারা তাকে বিশ্বাস করেছেন এবং সাহস যুগিয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রাণ, ইউএনডিপি, মাকালু ই ট্রেডার্স, সিস্টেমা টুথব্রাশ, মি. নুডলস, অদ্রি, 8K Expedition, সাকেব নাজিম (শুভ্র) এবং আরও অনেক শুভানুধ্যায়ীকে তাদের ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
শাকিলের এই যাত্রা এখানেই থেমে যায়নি, এটি কেবল শুরু। তার মতে, “সি টু সামিট” কেবল একটি অভিযান নয়, এটি একটি বার্তা, একটি বিপ্লব।