মা। ছোট্ট এই শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পৃথিবীর সব মায়া, মমতা, অকৃত্রিম স্নেহ, আদর, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সবটুকু সুখ। পাওয়া-না পাওয়ার এই পৃথিবীতে মায়ের ভালোবাসার সঙ্গে কোনোকিছুর তুলনা হয় না। মায়ের তুলনা মা নিজেই। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, মা মানে কী? আমি নিশ্চিন্তে উত্তর দেবো, মা মানে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং নির্ভরতার জায়গা।
প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালিত হয় বিশ্ব মা দিবস। এই দিনকে ঘিরে মায়েদের নিয়ে থাকে নানা আয়োজন-উদযাপন। মাকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা-সম্মান দেখানোর জন্য কোনো বিশেষ দিনক্ষণের প্রয়োজন নেই। তবুও একটা বিশেষ দিন থাকুক, যে দিনকে বিশেষভাবে রাঙিয়ে তোলা যায়। সন্তানের জন্য মা কত বড় আশীর্বাদ তা ভাষার প্রকাশ করা যাবে না। পৃথিবীর একমাত্র স্বার্থহীন সম্পর্ক হচ্ছে সন্তানের সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক। মাকে নিয়ে লিখে শেষ করার সামর্থ্য আমার নেই। তবুও মাকে নিয়ে লিখি। মনের মাধুরি মিশিয়ে বর্ণমালা দিয়ে মাকে সাজাই। অপ্রকাশিত অনুভূতি সাজাই শব্দে, বর্ণে আর কবিতার ছন্দে। তবুও কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা থেকে যায়, আফসোস থেকে যায়। চাইলেও সব অনুভূতি শব্দের মাধ্যমে পূর্ণতা দেওয়া যায় না।
মাকে নিয়ে কবি কাদের নেওয়াজ লিখেছিলেন- “মা কথাটি ছোট্ট অতি কিন্তু জেনো ভাই,/ ইহার চেয়ে নাম যে মধুর ত্রিভুবনে নাই/ সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক মাথার’ পরে আজি/ অন্তরে মা থাকুক মম, ঝরুক স্নেহরাজি।”। মাকে নিয়ে হাজারও কবি, সাহিত্যেক যুগে-যুগে লিখে গেছেন নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে। জন্মের পর থেকে শুরু করে শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের প্রতিটি পর্যায়ে মা জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মায়ের হাতে ভর দিয়ে পদচারণা শুরু, মায়ের চোখে পৃথিবী দেখা, গল্প শোনা, কলম ধরে এলোমেলো কিছু লিখতে চেষ্টা করা, আবার কখনো একটু ভয় পেয়ে মুরগির ছানার মতো বুকের মধ্যে লুকিয়ে পড়া, খানিক বাদে বের হয়ে আবার আকাশ দেখা এমন অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে থাকে মানুষটির সঙ্গে। মায়ের সঙ্গে সন্তানের জীবনের প্রতিটি পদেপদে জড়িয়ে থাকে হাজারও সুখকর স্মৃতি। সেই স্মৃতি আমাদের বাঁচতে শেখায়, সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এগিয়ে যাওয়ার ব্রত হিসেবে কাজ করে।
দুঃখ-কষ্ট, ভালো সময়, খারাপ সময়- সবকিছুতেই মাকে ভীষণ মনে পরে। মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য ঘর ছেড়েছি সে-ও পাঁচ বছর। মাঝেমাঝে মনে হয়, সবকিছু ছেড়ে আমার মায়ের কাছে ছুটে যাই। পরক্ষণেই মনে হয়, আমি তো মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে আসছি। মায়ের স্বপ্ন মানে আমারই স্বপ্ন। মায়ের মুখে হাসি মানে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। বটবৃক্ষ বাবাকে নিয়ে অন্যদিন লিখব। একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাদের মাতৃত্ব আর পিতৃত্বের সব ভালোবাসা একাই পেয়েছি। মায়ের সঙ্গে তৈরি হয়েছে পাহাড়সম স্মৃতি! ছোটবেলা থেকেই বেশির ভাগ সময় মায়ের সঙ্গেই কেটেছে। যখন থেকে বুঝতে শিখি, তখন থেকে মায়ের শাড়ির আঁচল ছাড়িনি।
মায়ের কোল আর শাড়ির আঁচল আমার সবচেয়ে শান্তির জায়গা। ইন্টারমিডিয়েটের আগ পর্যন্ত মাকে ছাড়া একা কোথাও এক রাতও গিয়ে থাকিনি। কিছু সময়ের জন্য মাকে না দেখলে আমার দম বন্ধ লাগতো যেন! এখনো স্পষ্ট মনে আছে, যখন জেএসসি সমাপনী পরীক্ষা দিই তখন শীতের সময় ছিল। পরীক্ষার দিন শীতের সকাল সকাল মা আমাকে পুকুর পাড়ে রোদের কাছে নিয়ে নিজ হাতে গোসল করিয়ে দিতেন। নিজ হাতে গরম ভাত খাইয়ে দিতেন। পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগ মুহুর্তে বিভিন্ন দোয়া-দরুদ পাঠ করে আমাকে ফুঁ দিয়ে দিতেন। মায়ের দেওয়া সেই ফুঁ আর দোয়াতেই চলছে আমার জীবন!
মা, তোমারও নিশ্চয়ই মনে আছে? কতশত স্মৃতি আর গল্প জমে আছে স্মৃতির আঙ্গিনায়। এসব স্মৃতি আজন্ম বেঁচে থাকুক মনের গোপন কুঠুরিতে। দীর্ঘায়িত হোক আমার মায়ের জীবনের আয়ুরেখা। আমার জীবনের আয়ুর কিছু অংশ যদি মাকে দিতে পারতাম! প্রিয় মা, তোমার ছেলে তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে! আমার চোখে তুমি পৃথিবীর সেরা মা। আমার জন্য তোমার পরিশ্রম, ত্যাগ, কত শত সংগ্রাম! যার বিনিময়ে আমি আজ এতদূর। তোমার স্বপ্ন তোমার ছেলে ডাক্তার হবে। সেই পথেই হেঁটে চলেছি। জানো মা, আমার লেখালেখির অনেকটা অংশ জুড়ে শুধুই তুমি। তোমার দেওয়া অনুপ্রেরণায় আমি আজ সামান্য লেখক। মানুষ যখন আমাকে লেখক বলে ডাকে তখন তোমাকে ভীষণ মনে পরে মা। আমার সব অর্জন তোমার জন্যই মা।
মা দিবসে আমার একটাই চাওয়া, বৃদ্ধাশ্রম নামক শব্দটি আমাদের সমাজ থেকে মুছে যাক। তৈরি হোক ভালোবাসার বন্ধন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হলেও সত্য যে, অনেক মায়ের শেষ জীবনে আশ্রয় হয় বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে! অথচ আমরা ভুলেই যাই যে, একজন মা প্রসবকালীন সময়ে ২০টি হাড়ভাঙা ব্যথার সমান ব্যথা অনুভব করেন। যা পৃথিবীর কষ্টকর ব্যথাগুলোর একটি। প্রসবব্যথার সঙ্গে আর কোনো ব্যথার তুলনা করা যায় না। অথচ এই গর্ভধারিণী মাকে বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে রেখে আসি! আফসোস! এই মা দিবসে একটাই প্রত্যাশা- পৃথিবীর সকল মায়েরা থাকুক সম্মান আর ভালোবাসায়।