ঢাকা ০৪:৫১ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৫ মে ২০২৫, ২২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪ ঘণ্টা পরীক্ষা ও সেবা পাবে রোগী

নিরাপদ ও মানবিক হাসপাতাল গড়ার সুপারিশ কমিশনের

  • অনলাইন ডেস্ক
  • আপডেট সময় : ১২:৪৪:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ মে ২০২৫
  • ২ বার পড়া হয়েছে

সারা দেশে চিকিৎসাসেবার মান বাড়ানো, চিকিৎসক-রোগী আস্থার সংকট দূর করা, সেবাকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলা এবং হাসপাতালগুলোকে নিরাপদ ও মানবিক করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে একগুচ্ছ প্রস্তাবনা ও সুপারিশ তৈরি করেছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কারে গঠিত কমিশন। সোমবার (৫ মে) কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, কমিশনের খসড়া সুপারিশে ব্যতিক্রমী ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রস্তাবনা উঠে এসেছে। যার মধ্যে আছে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ, উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা, জিপি-রেফার্ড সিস্টেম চালু প্রভৃতি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে শুধু সেবার মান ভালো হবে তাই নয়, ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়।

তবে এসব সুপারিশ কি আদৌ বাস্তবায়ন হবে নাকি ফাইলবন্দি হয়েই বছরের পর বছর পড়ে থাকবে সেই আলোচনা শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।

২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খানকে প্রধান করে ১২ সদস্যবিশিষ্ট স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিশনে একজন ছাত্র প্রতিনিধি ও একজন সাবেক আমলা রয়েছেন। অন্যরা চিকিৎসক। ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের কাছে জমা দেওয়ার কথা ছিল। পরে দুই দফায় সময় বাড়িয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়।

কমিশনের ছয়জন সদস্যকে ছয়টি বিষয়ের প্রধান করে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও সুপারিশ প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রত্যেক সদস্য একে অন্যকে তথ্য সংগ্রহ ও প্রতিবেদন প্রস্তুত করার কাজে সহায়তা করেছেন বলে জানা গেছে।

প্রাইভেট প্র্যাকটিসে প্রশিক্ষণের বাধ্যবাধকতা

স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশনের একাধিক সদস্য এবং কমিশন সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ৭০ থেকে ৮০ বছর বয়সেও যদি একজন চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন তাকে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর ‘অ্যাক্রেডিটেড প্রশিক্ষণ’ নিয়ে আসতে হবে। এই সুপারিশের ভিত্তিতে সেবার মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি নবীন-প্রবীণ চিকিৎসকদের পেশাগত ও নৈতিক দক্ষতা গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

কমিশনের একজন সদস্য বলেন, ‘জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চিকিৎসকদের যে মানোন্নয়ন সারা বিশ্বে হচ্ছে, সেটার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের গুণগত মান তারা যাতে বজায় রাখতে পারেন সেজন্য তাদের জন্য অ্যাক্রেডিটেড প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এমনকি তা চলমান থাকবে। যেমন আমি নিজেও একজন ডাক্তার, আমাকে যদি ডাক্তারি করতেই হয় তাহলে ৭০-৮০ বছর বয়স হলেও আমাকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এতে করে আমাদের চিকিৎসকরা নতুন নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আপডেটেড থাকবেন। কিন্তু এ ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বা কোনো বাধ্যবাধকতা এতদিন ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘প্রশিক্ষণের বাধ্যবাধকতা শুধু ডাক্তারের জন্যই নয়, বরং নার্স-প্যারামেডিকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর জন্যই প্রযোজ্য। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবেন এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে আপগ্রেডেড থাকবেন।’

থাকবে জিপি ব্যবস্থা, জটিলতা থাকলেই রোগী যাবে বিশেষজ্ঞের কাছে

কমিশন সূত্র জানিয়েছে, সংস্কার কমিশনের সুপারিশে স্বাস্থ্যসেবায় শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রস্তাব করা হয়েছে জিপি-রেফার্ড সিস্টেমের। যেখানে সাধারণ চিকিৎসক প্রাথমিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করবেন এবং জটিলতা থাকলে রোগীকে রেফার করবেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে।

কমিশনের এক সদস্য জানান, প্রস্তাবিত রেফারেল সিস্টেমে রোগী প্রথমে ইউনিয়ন সাব-সেন্টার বা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে যাবেন। উপজেলা পর্যায়ে থাকবে বিশেষায়িত চিকিৎসার ব্যবস্থা, যেখানে চিকিৎসকরা অধিকাংশ সমস্যার সমাধান করবেন। তবে জটিলতা থাকলে রোগীকে সরকারিভাবে জেলা হাসপাতাল এবং প্রয়োজনে সেখান থেকে টারশিয়ারি হাসপাতাল পর্যন্ত পাঠানো হবে। চিকিৎসা শেষে রোগী পুনরায় উপজেলা পর্যায়ে ফেরত যাবেন– এ ব্যবস্থাকেই বলা হচ্ছে ‘রেফার্ড আপ’ ও ‘রেফার্ড ডাউন’।

তিনি আরও জানান, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সচল রাখতে সরকার নতুনভাবে ভাবছে। তবে কমিশন গুরুত্ব দিচ্ছে জিপি ব্যবস্থায়। নির্দিষ্ট সংখ্যক জনগণের জন্য একজন জেনারেল প্র্যাকটিশনার (জিপি) থাকবেন, যার মাধ্যমে রোগীরা প্রাথমিক সেবা পাবেন এবং প্রয়োজনে পরবর্তী পর্যায়ে রেফার হবেন। এ ব্যবস্থায় একজন জিপি কতজন রোগীর দায়িত্বে থাকবেন– সে বিষয়ে কমিশন সরকারকে সুপারিশ দিয়েছে।

উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা সেবা

স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সহজলভ্য করতে প্রস্তাব এসেছে ২৪ ঘণ্টা পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার। দিন-রাত, শহর-গ্রাম– সবখানেই যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা মেলে, সেই লক্ষ্যেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

কমিশনের এক সদস্য বলেন, আমরা সুপারিশ করেছি যেন উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসক-নার্স থেকে শুরু করে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার পর্যন্ত সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী ও সাপোর্টিভ স্টাফদের ডিউটিতে রাখা হয়। সেইসঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টাই যেন হাসপাতালের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু রাখা হয়। কারণ কখন কোন রোগীকে হাসপাতালে আসতে হয় তার তো কোনো ঠিক নেই।

তিনি আরও বলেন, মানুষ তো আর সময় বুঝে অসুস্থ হয় না। কিন্তু একজন ব্যক্তি যদি রাতের বেলায় অসুস্থ অবস্থায় সেবা নিতে এসে সেবা না পায়, তাহলে সে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হলো। তাই এই বিষয়টিতে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। একজন রোগী যখন উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি হবেন তিনি সেই হাসপাতালে থেকেই চিকিৎসা নেবেন।

dhakapost

হাসপাতালে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স, রোগীর জন্য থাকবে সহকারী

উপজেলা বা জেলা হাসপাতাল কোনো জটিল রোগীর চিকিৎসা দিতে না পারলে রোগীকে অন্যত্র পাঠানোর দায় যেন পরিবারের ওপর না পড়ে– এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চায় স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স রাখার নির্দেশনা দেওয়া হবে। এই অ্যাম্বুলেন্সে ২৪ ঘণ্টা চালকসহ স্ট্যান্ডবাই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যেন যেকোনো মুহূর্তে জরুরি রোগীকে জেলা হাসপাতালে পাঠানো সম্ভব হয়।

শুধু অ্যাম্বুলেন্স থাকলেই চলবে না, কমিশনের মতে, রোগীর নিরাপদ স্থানান্তরের জন্য তার সঙ্গে একজন প্রশিক্ষিত নার্স বা স্বাস্থ্য সহকারী পাঠানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজন হলে অক্সিজেন, স্ট্রেচার বা প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রসহ তাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

একই প্রক্রিয়া জেলা হাসপাতালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। যদি রোগীকে টারশিয়ারি বা বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠাতে হয়, তাহলে জেলা হাসপাতালই সেটির সম্পূর্ণ দায়ভার গ্রহণ করবে। রোগীর পরিবারকে কোথাও দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না।

কমিশন বলছে, এ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় ‘রেফারেল চেইন’ কার্যকরভাবে কাজ করবে। রোগীরা সময়মতো সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারবে, চিকিৎসায় অবহেলা বা হয়রানির সুযোগ থাকবে না। এতে একদিকে যেমন চিকিৎসার মান বাড়বে, অন্যদিকে কমবে চিকিৎসা-সেবায় বৈষম্য।

‘হাসপাতাল পুলিশিং’ নয়, দরকার মানবিকতা ও নিজস্ব ব্যবস্থাপনা

হাসপাতালগুলোতে ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার অভিযোগে চিকিৎসক ও নার্সদের ওপর রোগীর স্বজনদের হামলার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় আলাদা ‘হাসপাতাল পুলিশিং’ ব্যবস্থার পক্ষে নয় স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। কমিশনের মতে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যবস্থাপনাই যথেষ্ট– যেমন গার্ড বা আনসার সদস্যরা এটা করবেন।

একজন সদস্য বলেন, মানুষ যদি পুলিশে ভয় না পায়, তাহলে হাসপাতালে পুলিশ বসিয়ে লাভ কী? বরং আমাদের খুঁজে বের করতে হবে মূল সংকটগুলো কোথায়। স্বজনকে চোখের সামনে মরতে দেখলে মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, সে পরিস্থিতিতে কেউই স্বাভাবিক থাকে না। পুলিশ থাকলেও হিতে বিপরীত হতে পারে।

তাই কমিশন বলছে, সমস্যার শেকড় ধরেই সমাধানে যেতে হবে। এ কারণে চিকিৎসকদের জন্য মেডিকেল এথিক্স ও কনফ্লিক্ট রেজুলেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। কোথায়, কী কারণে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়, কীভাবে চিকিৎসকরা সেসব মোকাবিলা করবেন– এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণের সুপারিশ রয়েছে।

কমিশনের মতে, নিরাপদ ও মানবিক হাসপাতাল ব্যবস্থার জন্য চিকিৎসকদের আরও সহানুভূতিশীল ও সংবেদনশীল হতে হবে। একটি সুন্দর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে রোগীরা চিকিৎসকদের দেখে শ্রদ্ধা অনুভব করবেন– ভয় বা ক্ষোভ নয়। তাহলেই সহিংসতা ও উত্তেজনা কমবে এবং প্রকৃত নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

স্কুল থেকেই শেখানো হবে রোগ প্রতিরোধ, ক্লাস নেবেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা

শিক্ষার্থীদের ছোটবেলা থেকে স্বাস্থ্য সচেতন করে গড়ে তুলতে স্কুল পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক শিক্ষা চালুর সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। তারা বলছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন স্বাস্থ্যবিষয়ক সঠিক জ্ঞান নিয়ে বড় হয়, সেই লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

স্কুলের পাঠ্যক্রমে স্বাস্থ্য শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে সেখানে শিক্ষার্থীদের শেখানো হবে– কীভাবে রোগ প্রতিরোধ করতে হয়, কী ধরনের খাবার শরীরের জন্য উপকারী, নিয়মিত ব্যায়ামের প্রয়োজনীয়তা ও পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব।

এ কার্যক্রম তদারকি করবেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। প্রয়োজন অনুযায়ী তিনি নিজেও সরাসরি স্কুলে গিয়ে ক্লাস নেবেন বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

শিক্ষক-নির্ভরতা কমিয়ে শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক হবে মেডিকেল কারিকুলাম

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মেডিকেল শিক্ষার পদ্ধতিগত পরিবর্তন জরুরি। বর্তমান কারিকুলাম শিক্ষক-নির্ভর হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা গড়ে উঠছে না। তাই শিক্ষকদের ভূমিকা হবে ‘ফ্যাসিলিটেটরে’র অর্থাৎ গাইড বা সহায়কের মতো। শেখার মূল দায়িত্ব থাকবে শিক্ষার্থীর কাঁধে।

মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও আনা হচ্ছে বড় পরিবর্তন। আগে যেখানে শুধু পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো, সেখানে এখন প্রস্তাব করা হয়েছে ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতির– ‘কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট’ এবং ‘সামিটিভ অ্যাসেসমেন্ট’। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থী কীভাবে শিখছে, কোথায় পিছিয়ে পড়ছে– এসব বিষয় নিয়মিত পর্যবেক্ষণের আওতায় আসবে। পাশাপাশি চূড়ান্ত বার্ষিক পরীক্ষা তো থাকবেই।

শিক্ষক চাইলে আর কাউকে ‘ইচ্ছেমতো’ ফেল করাতে পারবেন না– এমন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দৃষ্টান্তমূলক মূল্যায়ন কাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন।

dhakapost

শিক্ষার মান বজায় না রাখলে বন্ধ হবে সরকারি মেডিকেল কলেজও

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, মানহীন কোনো মেডিকেল কলেজই আর রাখা হবে না, সেটি সরকারি হোক বা বেসরকারি।

কমিশনের একজন সদস্য বলেন, ‘অনেক মেডিকেল কলেজেই রোগীর সংখ্যা খুবই কম, কোথাও আবার রোগী নেই বললেই চলে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে দক্ষ চিকিৎসক তৈরি সম্ভব নয়। তাই মেডিকেল শিক্ষার মানের বিষয়ে আমরা কোনো ছাড় দিতে রাজি নই।’

তিনি জানান, কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী যেসব মেডিকেল কলেজ মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে, তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হবে মানোন্নয়নের জন্য। এই সময়ের মধ্যেও যদি কাঙ্ক্ষিত মানে উন্নীত হতে না পারে, তাহলে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এ সিদ্ধান্ত শুধু বেসরকারি নয়, সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য প্রতিবাদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কে আন্দোলন করল, সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা আমাদের দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করব।’

ফার্মাসিস্ট ছাড়া ওষুধ নয়, নজরদারিতে থাকবে প্রতিটি ফার্মেসি

দেশের ফার্মেসিগুলোকে মানসম্মত ও সুশৃঙ্খল করতে কড়া অবস্থান নেওয়ার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, কোনো ফার্মেসিই এখন আর পেশাদার ফার্মাসিস্ট ছাড়া পরিচালিত হতে পারবে না। অর্থাৎ প্রতিটি ফার্মেসিতে থাকতে হবে লাইসেন্সধারী প্রশিক্ষিত একজন ফার্মাসিস্ট, যিনি ওষুধের সঠিক ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিক্রয়প্রক্রিয়া তদারকি করবেন।

কমিশনের এক সদস্য বলেন, ‘ওষুধ সংরক্ষণ, পরিবহন ও সরবরাহে যেন নীতিমালার কোনো ব্যত্যয় না ঘটে, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি কঠোর ও আধুনিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। তবে শুধু নীতিমালা করেই দায়িত্ব শেষ নয়, এসব নীতিমালার বাস্তবায়ন ও কার্যকর তদারকিও নিশ্চিত করতে হবে।’

এই তদারকির দায়িত্ব পড়বে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওপর। জেলা পর্যায়ে কাজটি দেখবেন সিভিল সার্জন ও তার নেতৃত্বাধীন টিম। একইসঙ্গে ওষুধের মূল্য নির্ধারণে যেন সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে আলাদা করে সুপারিশ রেখেছে কমিশন।

‘প্রস্তাবিত সংস্কার দেশের জনগণের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে’

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে প্রস্তাবিত সংস্কারের মাধ্যমে আমরা একটি সুনির্দিষ্ট, কার্যকরী এবং স্থিতিশীল পরিবর্তন দেখতে পাব, যা দেশের জনগণের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে। বর্তমান স্বাস্থ্যখাতের যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোর সমাধান নির্ভর করবে দ্রুত ও বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর কার্যকরী বাস্তবায়নের ওপর।’

তিনি বলেন, ‘যতটুকু জেনেছি সুপারিশগুলোর মধ্যে একটি বড় বিষয় হলো স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং গ্রামীণ ও শহরের প্রান্তিক জনগণের জন্য মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা। আমরা চাই, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে জনগণের জন্য একটি শক্তিশালী রেফারেল সিস্টেম গড়ে উঠুক, যাতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে বিশেষায়িত হাসপাতালে সুপারিশপ্রাপ্ত রোগী সহজেই চিকিৎসা নিতে পারে এবং পুনরায় নিজ উপজেলার স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে অব্যাহত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারে।’

ডা. শাহিনুল আলম বলেন, ‘ফার্মেসি ব্যবস্থাপনায় কোয়ালিফায়েড ফার্মাসিস্টের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করতে হবে, যা ওষুধের মান ও সঠিক ব্যবহারের ওপর আরও বেশি নজর দেবে। একইভাবে হাসপাতালগুলোর ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতের পরিবর্তন যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবার মানে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। সরকারের সহায়তায় আমরা আশা করছি এসব সুপারিশ দ্রুত কার্যকর করা হবে, যা দেশের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী এবং কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে। স্বাস্থ্যখাতে কার্যকরী সংস্কারের মাধ্যমে দেশে সুশাসন ও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠা সম্ভব এবং আমরা সেই পথেই এগিয়ে যেতে চাই।’

dhakapost

সুপারিশ বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন

স্বাস্থ্যখাত সংস্কারে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।

বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আমি মনে করি না কমিশনের সুপারিশ স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োগ সম্ভব। কারণ, যেসব উচ্চপদস্থ আমলা এবং কর্মকর্তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বসে আছেন, তারা কোনো ধরনের পরিবর্তনই পছন্দ করেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমত, এই কর্মকর্তারা পরিবর্তনকে ভয় পান। তাদের ভয়, যদি সংস্কার হয়, তাহলে তারা জানেন না কবে, কোথায়, কীভাবে তাদের চাকরি চলে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, তারা মনে করেন, নতুন কোনো সংস্থা বা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তাদের ওপর বাড়তি নজরদারি আসবে, যা তাদের ক্ষমতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।’

ডা. ফয়সাল বলেন, ‘একসময় বলা হয়েছিল স্বাস্থ্যখাতকে পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে আলাদা করে একটি বিশেষ কমিশন গঠন করা হবে। এ খবর শোনার পর তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। তারা ভাবছেন, যদি এটি বাস্তবায়িত হয় তবে তাদের নিয়ন্ত্রণ আর থাকবে না। তাদের মনে ভয় জেগেছে, যদি এমন কিছু ঘটে তবে আমাদের কী হবে?’

তিনি মন্তব্য করেন, ‘স্বাস্থ্যখাতের দায়িত্বশীলরা এ ধরনের ভুল চিন্তাভাবনার মধ্যে বসবাস করছেন। এ কারণে তারা সংস্কারের প্রতি আগ্রহী নন এবং এভাবেই তারা স্বাস্থ্যখাতে কার্যকরী কোনো পরিবর্তন বা সংস্থা প্রতিষ্ঠার পথে অদৃশ্য বাধা তৈরি করছেন।’

‘এই মন্ত্রণালয়ে যারা বসে আছেন, তারা বিশ্বাস করেন যে, কোনো ধরনের সংস্কার তাদের নিয়ন্ত্রণ বা ক্ষমতা ক্ষুণ্ন করবে। ফলস্বরূপ তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে সংস্কারের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে চলেছেন। কিন্তু আমরা জানি, স্বাস্থ্যখাতে সুষ্ঠু ও কার্যকরী সংস্কার ছাড়া দেশবাসী কখনো প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা পাবে না,’ যোগ করেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

‘রেফারেল সিস্টেম ও জনগণের জন্য উন্নত সেবা নিশ্চিতের পরিকল্পনা’

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমরা আমাদের সংস্কার প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে বাঁধাই করেছি। এখন প্রধান উপদেষ্টার অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সংস্কার প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতে অর্থায়ন, জনবল প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, সুশাসনের জন্য নেতৃত্ব, স্বাস্থ্য তত্ত্ব ব্যবস্থা এবং সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সংস্কৃতির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবায় ভৌত অবকাঠামোগত কিছু সুপারিশও রয়েছে।’

প্রস্তাবনার বাস্তবায়নযোগ্যতা সম্পর্কে ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমরা সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি করেছি এবং তা জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে সব প্রস্তাবই সরকার বাস্তবায়ন করবে এমন কিছু বলা সম্ভব নয়। সরকার কতটুকু সংস্কার করতে পারবে, কখন এবং কোন ক্ষেত্রে কত সময় নেবে– এগুলো তাদের সিদ্ধান্ত। তবে আমরা প্রস্তাবনা আকারে একটি টাইমলাইন নির্ধারণ করছি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য সার্বিক জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, তবে বিশেষভাবে গ্রামীণ ও শহরের প্রান্তিক জনগণকে সেবা প্রদান করার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা একটি কার্যকর রেফারেল সিস্টেম চালু করতে চাই, যার মাধ্যমে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে মানুষ সরাসরি বিশেষায়িত হাসপাতালে রেফার্ড হয়ে সেবা নিতে পারবেন। পরে তারা তাদের নিজ উপজেলায় ফিরে এসে বাকি স্বাস্থ্য সেবা পেতে পারবেন।’

ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমরা চাই আগামীতে যেন দেশের সব মানুষ সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে রেফারেল সিস্টেমের মাধ্যমে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারেন। যারা অর্থ খরচ করে জেলা-উপজেলা বা বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চান, তাদের জন্যও পৃথক একটি সিস্টেম তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৭ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন গঠন করে। জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খানকে কমিশনের প্রধান করা হয়। কমিশনের সদস্য করা হয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন, অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী, অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার, অধ্যাপক ডা. নায়লা জামান খান, সাবেক সচিব এস এম রেজা, অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক, ডা. আজহারুল ইসলাম খান, অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ডা. আহমেদ এহসানুর রাহমান ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী উমায়ের আফিফকে।

ট্যাগস :

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

২৪ ঘণ্টা পরীক্ষা ও সেবা পাবে রোগী

নিরাপদ ও মানবিক হাসপাতাল গড়ার সুপারিশ কমিশনের

আপডেট সময় : ১২:৪৪:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ৫ মে ২০২৫

সারা দেশে চিকিৎসাসেবার মান বাড়ানো, চিকিৎসক-রোগী আস্থার সংকট দূর করা, সেবাকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলা এবং হাসপাতালগুলোকে নিরাপদ ও মানবিক করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে একগুচ্ছ প্রস্তাবনা ও সুপারিশ তৈরি করেছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কারে গঠিত কমিশন। সোমবার (৫ মে) কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, কমিশনের খসড়া সুপারিশে ব্যতিক্রমী ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রস্তাবনা উঠে এসেছে। যার মধ্যে আছে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ, উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা, জিপি-রেফার্ড সিস্টেম চালু প্রভৃতি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে শুধু সেবার মান ভালো হবে তাই নয়, ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থায়।

তবে এসব সুপারিশ কি আদৌ বাস্তবায়ন হবে নাকি ফাইলবন্দি হয়েই বছরের পর বছর পড়ে থাকবে সেই আলোচনা শুরু হয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।

২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খানকে প্রধান করে ১২ সদস্যবিশিষ্ট স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিশনে একজন ছাত্র প্রতিনিধি ও একজন সাবেক আমলা রয়েছেন। অন্যরা চিকিৎসক। ৯০ দিনের মধ্যে কমিশনের প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের কাছে জমা দেওয়ার কথা ছিল। পরে দুই দফায় সময় বাড়িয়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়।

কমিশনের ছয়জন সদস্যকে ছয়টি বিষয়ের প্রধান করে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও সুপারিশ প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রত্যেক সদস্য একে অন্যকে তথ্য সংগ্রহ ও প্রতিবেদন প্রস্তুত করার কাজে সহায়তা করেছেন বলে জানা গেছে।

প্রাইভেট প্র্যাকটিসে প্রশিক্ষণের বাধ্যবাধকতা

স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্কার কমিশনের একাধিক সদস্য এবং কমিশন সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ৭০ থেকে ৮০ বছর বয়সেও যদি একজন চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন তাকে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর ‘অ্যাক্রেডিটেড প্রশিক্ষণ’ নিয়ে আসতে হবে। এই সুপারিশের ভিত্তিতে সেবার মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি নবীন-প্রবীণ চিকিৎসকদের পেশাগত ও নৈতিক দক্ষতা গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

কমিশনের একজন সদস্য বলেন, ‘জ্ঞান ও প্রযুক্তিতে চিকিৎসকদের যে মানোন্নয়ন সারা বিশ্বে হচ্ছে, সেটার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের গুণগত মান তারা যাতে বজায় রাখতে পারেন সেজন্য তাদের জন্য অ্যাক্রেডিটেড প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এমনকি তা চলমান থাকবে। যেমন আমি নিজেও একজন ডাক্তার, আমাকে যদি ডাক্তারি করতেই হয় তাহলে ৭০-৮০ বছর বয়স হলেও আমাকে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এতে করে আমাদের চিকিৎসকরা নতুন নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আপডেটেড থাকবেন। কিন্তু এ ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা বা কোনো বাধ্যবাধকতা এতদিন ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘প্রশিক্ষণের বাধ্যবাধকতা শুধু ডাক্তারের জন্যই নয়, বরং নার্স-প্যারামেডিকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর জন্যই প্রযোজ্য। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবেন এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে আপগ্রেডেড থাকবেন।’

থাকবে জিপি ব্যবস্থা, জটিলতা থাকলেই রোগী যাবে বিশেষজ্ঞের কাছে

কমিশন সূত্র জানিয়েছে, সংস্কার কমিশনের সুপারিশে স্বাস্থ্যসেবায় শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রস্তাব করা হয়েছে জিপি-রেফার্ড সিস্টেমের। যেখানে সাধারণ চিকিৎসক প্রাথমিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করবেন এবং জটিলতা থাকলে রোগীকে রেফার করবেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে।

কমিশনের এক সদস্য জানান, প্রস্তাবিত রেফারেল সিস্টেমে রোগী প্রথমে ইউনিয়ন সাব-সেন্টার বা কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সে যাবেন। উপজেলা পর্যায়ে থাকবে বিশেষায়িত চিকিৎসার ব্যবস্থা, যেখানে চিকিৎসকরা অধিকাংশ সমস্যার সমাধান করবেন। তবে জটিলতা থাকলে রোগীকে সরকারিভাবে জেলা হাসপাতাল এবং প্রয়োজনে সেখান থেকে টারশিয়ারি হাসপাতাল পর্যন্ত পাঠানো হবে। চিকিৎসা শেষে রোগী পুনরায় উপজেলা পর্যায়ে ফেরত যাবেন– এ ব্যবস্থাকেই বলা হচ্ছে ‘রেফার্ড আপ’ ও ‘রেফার্ড ডাউন’।

তিনি আরও জানান, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সচল রাখতে সরকার নতুনভাবে ভাবছে। তবে কমিশন গুরুত্ব দিচ্ছে জিপি ব্যবস্থায়। নির্দিষ্ট সংখ্যক জনগণের জন্য একজন জেনারেল প্র্যাকটিশনার (জিপি) থাকবেন, যার মাধ্যমে রোগীরা প্রাথমিক সেবা পাবেন এবং প্রয়োজনে পরবর্তী পর্যায়ে রেফার হবেন। এ ব্যবস্থায় একজন জিপি কতজন রোগীর দায়িত্বে থাকবেন– সে বিষয়ে কমিশন সরকারকে সুপারিশ দিয়েছে।

উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা সেবা

স্বাস্থ্যসেবাকে আরও সহজলভ্য করতে প্রস্তাব এসেছে ২৪ ঘণ্টা পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার। দিন-রাত, শহর-গ্রাম– সবখানেই যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে সেবা মেলে, সেই লক্ষ্যেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

কমিশনের এক সদস্য বলেন, আমরা সুপারিশ করেছি যেন উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসক-নার্স থেকে শুরু করে অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার পর্যন্ত সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী ও সাপোর্টিভ স্টাফদের ডিউটিতে রাখা হয়। সেইসঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টাই যেন হাসপাতালের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালু রাখা হয়। কারণ কখন কোন রোগীকে হাসপাতালে আসতে হয় তার তো কোনো ঠিক নেই।

তিনি আরও বলেন, মানুষ তো আর সময় বুঝে অসুস্থ হয় না। কিন্তু একজন ব্যক্তি যদি রাতের বেলায় অসুস্থ অবস্থায় সেবা নিতে এসে সেবা না পায়, তাহলে সে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হলো। তাই এই বিষয়টিতে আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। একজন রোগী যখন উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি হবেন তিনি সেই হাসপাতালে থেকেই চিকিৎসা নেবেন।

dhakapost

হাসপাতালে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স, রোগীর জন্য থাকবে সহকারী

উপজেলা বা জেলা হাসপাতাল কোনো জটিল রোগীর চিকিৎসা দিতে না পারলে রোগীকে অন্যত্র পাঠানোর দায় যেন পরিবারের ওপর না পড়ে– এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে চায় স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স রাখার নির্দেশনা দেওয়া হবে। এই অ্যাম্বুলেন্সে ২৪ ঘণ্টা চালকসহ স্ট্যান্ডবাই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যেন যেকোনো মুহূর্তে জরুরি রোগীকে জেলা হাসপাতালে পাঠানো সম্ভব হয়।

শুধু অ্যাম্বুলেন্স থাকলেই চলবে না, কমিশনের মতে, রোগীর নিরাপদ স্থানান্তরের জন্য তার সঙ্গে একজন প্রশিক্ষিত নার্স বা স্বাস্থ্য সহকারী পাঠানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজন হলে অক্সিজেন, স্ট্রেচার বা প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রসহ তাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

একই প্রক্রিয়া জেলা হাসপাতালের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। যদি রোগীকে টারশিয়ারি বা বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠাতে হয়, তাহলে জেলা হাসপাতালই সেটির সম্পূর্ণ দায়ভার গ্রহণ করবে। রোগীর পরিবারকে কোথাও দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না।

কমিশন বলছে, এ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় ‘রেফারেল চেইন’ কার্যকরভাবে কাজ করবে। রোগীরা সময়মতো সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারবে, চিকিৎসায় অবহেলা বা হয়রানির সুযোগ থাকবে না। এতে একদিকে যেমন চিকিৎসার মান বাড়বে, অন্যদিকে কমবে চিকিৎসা-সেবায় বৈষম্য।

‘হাসপাতাল পুলিশিং’ নয়, দরকার মানবিকতা ও নিজস্ব ব্যবস্থাপনা

হাসপাতালগুলোতে ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার অভিযোগে চিকিৎসক ও নার্সদের ওপর রোগীর স্বজনদের হামলার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় আলাদা ‘হাসপাতাল পুলিশিং’ ব্যবস্থার পক্ষে নয় স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। কমিশনের মতে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যবস্থাপনাই যথেষ্ট– যেমন গার্ড বা আনসার সদস্যরা এটা করবেন।

একজন সদস্য বলেন, মানুষ যদি পুলিশে ভয় না পায়, তাহলে হাসপাতালে পুলিশ বসিয়ে লাভ কী? বরং আমাদের খুঁজে বের করতে হবে মূল সংকটগুলো কোথায়। স্বজনকে চোখের সামনে মরতে দেখলে মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, সে পরিস্থিতিতে কেউই স্বাভাবিক থাকে না। পুলিশ থাকলেও হিতে বিপরীত হতে পারে।

তাই কমিশন বলছে, সমস্যার শেকড় ধরেই সমাধানে যেতে হবে। এ কারণে চিকিৎসকদের জন্য মেডিকেল এথিক্স ও কনফ্লিক্ট রেজুলেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হচ্ছে। কোথায়, কী কারণে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়, কীভাবে চিকিৎসকরা সেসব মোকাবিলা করবেন– এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণের সুপারিশ রয়েছে।

কমিশনের মতে, নিরাপদ ও মানবিক হাসপাতাল ব্যবস্থার জন্য চিকিৎসকদের আরও সহানুভূতিশীল ও সংবেদনশীল হতে হবে। একটি সুন্দর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে রোগীরা চিকিৎসকদের দেখে শ্রদ্ধা অনুভব করবেন– ভয় বা ক্ষোভ নয়। তাহলেই সহিংসতা ও উত্তেজনা কমবে এবং প্রকৃত নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।

স্কুল থেকেই শেখানো হবে রোগ প্রতিরোধ, ক্লাস নেবেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা

শিক্ষার্থীদের ছোটবেলা থেকে স্বাস্থ্য সচেতন করে গড়ে তুলতে স্কুল পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক শিক্ষা চালুর সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। তারা বলছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন স্বাস্থ্যবিষয়ক সঠিক জ্ঞান নিয়ে বড় হয়, সেই লক্ষ্যে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

স্কুলের পাঠ্যক্রমে স্বাস্থ্য শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে সেখানে শিক্ষার্থীদের শেখানো হবে– কীভাবে রোগ প্রতিরোধ করতে হয়, কী ধরনের খাবার শরীরের জন্য উপকারী, নিয়মিত ব্যায়ামের প্রয়োজনীয়তা ও পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব।

এ কার্যক্রম তদারকি করবেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। প্রয়োজন অনুযায়ী তিনি নিজেও সরাসরি স্কুলে গিয়ে ক্লাস নেবেন বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

শিক্ষক-নির্ভরতা কমিয়ে শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক হবে মেডিকেল কারিকুলাম

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মেডিকেল শিক্ষার পদ্ধতিগত পরিবর্তন জরুরি। বর্তমান কারিকুলাম শিক্ষক-নির্ভর হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা গড়ে উঠছে না। তাই শিক্ষকদের ভূমিকা হবে ‘ফ্যাসিলিটেটরে’র অর্থাৎ গাইড বা সহায়কের মতো। শেখার মূল দায়িত্ব থাকবে শিক্ষার্থীর কাঁধে।

মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও আনা হচ্ছে বড় পরিবর্তন। আগে যেখানে শুধু পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হতো, সেখানে এখন প্রস্তাব করা হয়েছে ধারাবাহিক মূল্যায়ন পদ্ধতির– ‘কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট’ এবং ‘সামিটিভ অ্যাসেসমেন্ট’। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থী কীভাবে শিখছে, কোথায় পিছিয়ে পড়ছে– এসব বিষয় নিয়মিত পর্যবেক্ষণের আওতায় আসবে। পাশাপাশি চূড়ান্ত বার্ষিক পরীক্ষা তো থাকবেই।

শিক্ষক চাইলে আর কাউকে ‘ইচ্ছেমতো’ ফেল করাতে পারবেন না– এমন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও দৃষ্টান্তমূলক মূল্যায়ন কাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন।

dhakapost

শিক্ষার মান বজায় না রাখলে বন্ধ হবে সরকারি মেডিকেল কলেজও

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, মানহীন কোনো মেডিকেল কলেজই আর রাখা হবে না, সেটি সরকারি হোক বা বেসরকারি।

কমিশনের একজন সদস্য বলেন, ‘অনেক মেডিকেল কলেজেই রোগীর সংখ্যা খুবই কম, কোথাও আবার রোগী নেই বললেই চলে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে দক্ষ চিকিৎসক তৈরি সম্ভব নয়। তাই মেডিকেল শিক্ষার মানের বিষয়ে আমরা কোনো ছাড় দিতে রাজি নই।’

তিনি জানান, কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী যেসব মেডিকেল কলেজ মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হবে, তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া হবে মানোন্নয়নের জন্য। এই সময়ের মধ্যেও যদি কাঙ্ক্ষিত মানে উন্নীত হতে না পারে, তাহলে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

এ সিদ্ধান্ত শুধু বেসরকারি নয়, সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য প্রতিবাদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কে আন্দোলন করল, সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমরা আমাদের দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করব।’

ফার্মাসিস্ট ছাড়া ওষুধ নয়, নজরদারিতে থাকবে প্রতিটি ফার্মেসি

দেশের ফার্মেসিগুলোকে মানসম্মত ও সুশৃঙ্খল করতে কড়া অবস্থান নেওয়ার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, কোনো ফার্মেসিই এখন আর পেশাদার ফার্মাসিস্ট ছাড়া পরিচালিত হতে পারবে না। অর্থাৎ প্রতিটি ফার্মেসিতে থাকতে হবে লাইসেন্সধারী প্রশিক্ষিত একজন ফার্মাসিস্ট, যিনি ওষুধের সঠিক ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিক্রয়প্রক্রিয়া তদারকি করবেন।

কমিশনের এক সদস্য বলেন, ‘ওষুধ সংরক্ষণ, পরিবহন ও সরবরাহে যেন নীতিমালার কোনো ব্যত্যয় না ঘটে, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি কঠোর ও আধুনিক নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। তবে শুধু নীতিমালা করেই দায়িত্ব শেষ নয়, এসব নীতিমালার বাস্তবায়ন ও কার্যকর তদারকিও নিশ্চিত করতে হবে।’

এই তদারকির দায়িত্ব পড়বে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওপর। জেলা পর্যায়ে কাজটি দেখবেন সিভিল সার্জন ও তার নেতৃত্বাধীন টিম। একইসঙ্গে ওষুধের মূল্য নির্ধারণে যেন সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে আলাদা করে সুপারিশ রেখেছে কমিশন।

‘প্রস্তাবিত সংস্কার দেশের জনগণের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে’

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতে প্রস্তাবিত সংস্কারের মাধ্যমে আমরা একটি সুনির্দিষ্ট, কার্যকরী এবং স্থিতিশীল পরিবর্তন দেখতে পাব, যা দেশের জনগণের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে। বর্তমান স্বাস্থ্যখাতের যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোর সমাধান নির্ভর করবে দ্রুত ও বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলোর কার্যকরী বাস্তবায়নের ওপর।’

তিনি বলেন, ‘যতটুকু জেনেছি সুপারিশগুলোর মধ্যে একটি বড় বিষয় হলো স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ এবং গ্রামীণ ও শহরের প্রান্তিক জনগণের জন্য মানসম্মত সেবা নিশ্চিত করা। আমরা চাই, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে জনগণের জন্য একটি শক্তিশালী রেফারেল সিস্টেম গড়ে উঠুক, যাতে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে বিশেষায়িত হাসপাতালে সুপারিশপ্রাপ্ত রোগী সহজেই চিকিৎসা নিতে পারে এবং পুনরায় নিজ উপজেলার স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে অব্যাহত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারে।’

ডা. শাহিনুল আলম বলেন, ‘ফার্মেসি ব্যবস্থাপনায় কোয়ালিফায়েড ফার্মাসিস্টের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করতে হবে, যা ওষুধের মান ও সঠিক ব্যবহারের ওপর আরও বেশি নজর দেবে। একইভাবে হাসপাতালগুলোর ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতের পরিবর্তন যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবার মানে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। সরকারের সহায়তায় আমরা আশা করছি এসব সুপারিশ দ্রুত কার্যকর করা হবে, যা দেশের মানুষের জন্য সাশ্রয়ী এবং কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে। স্বাস্থ্যখাতে কার্যকরী সংস্কারের মাধ্যমে দেশে সুশাসন ও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠা সম্ভব এবং আমরা সেই পথেই এগিয়ে যেতে চাই।’

dhakapost

সুপারিশ বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন

স্বাস্থ্যখাত সংস্কারে এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ।

বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘আমি মনে করি না কমিশনের সুপারিশ স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োগ সম্ভব। কারণ, যেসব উচ্চপদস্থ আমলা এবং কর্মকর্তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বসে আছেন, তারা কোনো ধরনের পরিবর্তনই পছন্দ করেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমত, এই কর্মকর্তারা পরিবর্তনকে ভয় পান। তাদের ভয়, যদি সংস্কার হয়, তাহলে তারা জানেন না কবে, কোথায়, কীভাবে তাদের চাকরি চলে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, তারা মনে করেন, নতুন কোনো সংস্থা বা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তাদের ওপর বাড়তি নজরদারি আসবে, যা তাদের ক্ষমতাকে হুমকির মুখে ফেলবে।’

ডা. ফয়সাল বলেন, ‘একসময় বলা হয়েছিল স্বাস্থ্যখাতকে পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে আলাদা করে একটি বিশেষ কমিশন গঠন করা হবে। এ খবর শোনার পর তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। তারা ভাবছেন, যদি এটি বাস্তবায়িত হয় তবে তাদের নিয়ন্ত্রণ আর থাকবে না। তাদের মনে ভয় জেগেছে, যদি এমন কিছু ঘটে তবে আমাদের কী হবে?’

তিনি মন্তব্য করেন, ‘স্বাস্থ্যখাতের দায়িত্বশীলরা এ ধরনের ভুল চিন্তাভাবনার মধ্যে বসবাস করছেন। এ কারণে তারা সংস্কারের প্রতি আগ্রহী নন এবং এভাবেই তারা স্বাস্থ্যখাতে কার্যকরী কোনো পরিবর্তন বা সংস্থা প্রতিষ্ঠার পথে অদৃশ্য বাধা তৈরি করছেন।’

‘এই মন্ত্রণালয়ে যারা বসে আছেন, তারা বিশ্বাস করেন যে, কোনো ধরনের সংস্কার তাদের নিয়ন্ত্রণ বা ক্ষমতা ক্ষুণ্ন করবে। ফলস্বরূপ তারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে সংস্কারের প্রতি অনীহা প্রকাশ করে চলেছেন। কিন্তু আমরা জানি, স্বাস্থ্যখাতে সুষ্ঠু ও কার্যকরী সংস্কার ছাড়া দেশবাসী কখনো প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা পাবে না,’ যোগ করেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

‘রেফারেল সিস্টেম ও জনগণের জন্য উন্নত সেবা নিশ্চিতের পরিকল্পনা’

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমরা আমাদের সংস্কার প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে বাঁধাই করেছি। এখন প্রধান উপদেষ্টার অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সংস্কার প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতে অর্থায়ন, জনবল প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা, সুশাসনের জন্য নেতৃত্ব, স্বাস্থ্য তত্ত্ব ব্যবস্থা এবং সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সংস্কৃতির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবায় ভৌত অবকাঠামোগত কিছু সুপারিশও রয়েছে।’

প্রস্তাবনার বাস্তবায়নযোগ্যতা সম্পর্কে ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমরা সংস্কার প্রস্তাবনা তৈরি করেছি এবং তা জমা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে সব প্রস্তাবই সরকার বাস্তবায়ন করবে এমন কিছু বলা সম্ভব নয়। সরকার কতটুকু সংস্কার করতে পারবে, কখন এবং কোন ক্ষেত্রে কত সময় নেবে– এগুলো তাদের সিদ্ধান্ত। তবে আমরা প্রস্তাবনা আকারে একটি টাইমলাইন নির্ধারণ করছি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য সার্বিক জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, তবে বিশেষভাবে গ্রামীণ ও শহরের প্রান্তিক জনগণকে সেবা প্রদান করার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা একটি কার্যকর রেফারেল সিস্টেম চালু করতে চাই, যার মাধ্যমে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে মানুষ সরাসরি বিশেষায়িত হাসপাতালে রেফার্ড হয়ে সেবা নিতে পারবেন। পরে তারা তাদের নিজ উপজেলায় ফিরে এসে বাকি স্বাস্থ্য সেবা পেতে পারবেন।’

ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘আমরা চাই আগামীতে যেন দেশের সব মানুষ সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে রেফারেল সিস্টেমের মাধ্যমে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারেন। যারা অর্থ খরচ করে জেলা-উপজেলা বা বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চান, তাদের জন্যও পৃথক একটি সিস্টেম তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৭ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন গঠন করে। জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খানকে কমিশনের প্রধান করা হয়। কমিশনের সদস্য করা হয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন, অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী, অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার, অধ্যাপক ডা. নায়লা জামান খান, সাবেক সচিব এস এম রেজা, অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক, ডা. আজহারুল ইসলাম খান, অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন, অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, ডা. আহমেদ এহসানুর রাহমান ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী উমায়ের আফিফকে।