২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই মাসে প্রবাসীরা মোট ২৫২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ৩১,০৯৪ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২৩ টাকা হিসাবে)। এই পরিমাণ গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় ২৫ শতাংশ বেশি; ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২ কোটি ডলার। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে সরকার পরিবর্তনের পর প্রবাসীরা হুন্ডির পরিবর্তে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠানো বৃদ্ধি করেছেন। এর ফলে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ ১.০৭ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে, যা পূর্ববর্তী বছর ২০২৩ এর তুলনায় ৮০.২২ শতাংশ রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ১,৮৪৯ কোটি মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩.৮০ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরের একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ১,৪৯৩ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। ব্যাংকারদের মতে, নতুন সরকারের উৎসাহে প্রবাসীরা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন, যা ব্যাংকিং চ্যানেলের রেমিটেন্স বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকেই সবচেয়ে বেশি ৩২২ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এরপর এসেছে ১১৩ মিলিয়ন ডলার রূপালী ব্যাংকে। এছাড়াও, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪০২ মিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে ইসলামী ব্যাংকে। তারপরেই ২৪৫ মিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে ট্রাস্ট ব্যাংকে। এছাড়া বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এই মাসে ১০৯ মিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে।
ইসলামী ব্যাংকে রেমিটেন্স বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিপক্ষ জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করলেও তারা যথাপোযুক্ত তেমন প্রমান দিতে পারেনি। তবে রাজনীতিবিদদের মতে, আওয়ামীলীগ সরকারকে নিরুৎসাহিত করতেই ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ইসলামিক ব্যাংকগুলোতে প্রবাসীরা সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছে। সেখানে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তাদের প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছু নয়।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানান, রমজান ও দুই ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা সাধারণত পরিবারের জন্য বেশি পরিমাণে রেমিট্যান্স পাঠান। এছাড়া, খোলা বাজারের তুলনায় আনুষ্ঠানিক মুদ্রাবাজারের ডলারের দামে ব্যবধান কম থাকায় প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলেই বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত মাসে মোট ২.৪০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে, যা গত বছরের একই মাসে ১.৩৩ বিলিয়ন ডলার ছিল।
এছাড়া, সেপ্টেম্বর মাসে রেমিটেন্স গত মাসের তুলনায় ১৮০ মিলিয়ন ডলার বেড়েছে, যা গত তিন মাসে সর্বোচ্চ প্রবাহ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি ডলার ১২০ টাকায় কিনছেন। গত সেপ্টেম্বরে এই বিনিময় মূল্য স্থিতিশীল থাকলেও, শেষ সপ্তাহে ১২০.৫ টাকার আশেপাশে কিনতে হয়েছে। বর্তমানে ক্রলিং পেগ হার ১২১ টাকা এবং ব্যাংকগুলো লেটার অব ক্রেডিটের জন্য ১২১ টাকা চার্জ করছে। অপরদিকে, রপ্তানিকারকরা রপ্তানি প্রবাহের জন্য প্রতি ডলারে ১১৯ টাকা পাচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, অনেক ব্যাংক ডলারের নিট ওপেন পজিশন (এনওপি) পজিটিভ রয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর যে পরিমাণে দায় রয়েছে, তার তুলনায় ডলার প্রবাহ বেশি রয়েছে। “আগামী দু’মাসের মধ্যে বিদেশী ব্যাংকগুলোর ওভারডিউ পেমেন্টগুলো কমে আসবে। এছাড়া, রেমিটেন্সের প্রবাহ আরও বাড়লে ডলার মার্কেট পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থানে চলে আসবে।”
রেমিট্যান্স প্রবাহের এই ইতিবাচক ধারা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতেও সহায়তা করছে। গতবছরের শেষদিকে দেশের বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯.৫৬ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ ২০.৮৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। সার্বিকভাবে, প্রবাসী আয়ের এই ঊর্ধ্বগতি দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
হঠাৎ করে বাংলাদেশে রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে বিদেশী ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বর্তমানে রেমিটেন্স বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি এবং হুন্ডি ব্যবস্থার ব্যবহার কমে যাওয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, ২০১০ সালের দিকে জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতামূলক কর্মসূচির অর্থ আত্মসাতের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে চিহ্নিত হয়েছে, যা জঙ্গিবাদ বিরোধী প্রচেষ্টায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
তারা আরও বলেন, রেমিটেন্স বৃদ্ধির ফলে ডলার বাজার স্থিতিশীল হয়েছে এবং ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ডলারের বিনিময় হার টাকায় ১২০ টাকায় স্থির রয়েছে। আগে ব্যাংক এবং কার্ব মার্কেটের মধ্যে ৩ থেকে ৪ টাকার একটি ধারাবাহিক পার্থক্য ছিল। কিন্তু এখন উভয় বাজারের হার একীভূত হয়েছে।
ব্যাংকারদের মতে, রেমিটেন্স বৃদ্ধির একটি মূল কারণ হলো ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে লেনদেন। নতুন সরকারের প্রতি উৎসাহ দিতে প্রবাসীরা সক্রিয়ভাবে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন।
সর্বোপরি, রেমিটেন্স বৃদ্ধির পেছনে প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি এবং হুন্ডি ব্যবস্থার ব্যবহার কমে যাওয়াকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। জঙ্গি সংগঠনের অর্থায়ন বা লেনদেন সম্পর্কে নির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করা সম্ভব নয়।